আত্মা বনাম আমি

Spread the love

একটা সময় ছিল, যখন আমি নিজের নাম, পরিচয়, পেশা, সামাজিক অবস্থান—এইসব দিয়ে নিজেকে চিনতাম।
কিন্তু একটা দিনের পর দিন, সবকিছু ভালো চলার পরেও, হৃদয়ের কোথাও একটা গহ্বর তৈরি হতে লাগল।
যেমন নদীর নিচে জমে থাকা কাদার মতো—চোখে দেখা যায় না, কিন্তু পা দিলে টের পাওয়া যায়, নীচে কিছু ভারী, গভীর, অব্যক্ত।

সেই মুহূর্তে ভাগবত গীতার এই বাক্যটা মাথায় ঘুরতে থাকে—

📖 যিনি আত্মা, তিনি কখনো জন্মান না, মরেন না। তিনি চিরন্তন।”
(ভাগবত গীতা ২.২০)

আমি ভাবি—এতদিন আমি কাকে নিয়ে বেঁচে ছিলাম?
যে জন্ম নেয়, দুঃখ পায়, রেগে যায়, ঈর্ষা করে—সে কি আমি?
নাকি আমার ভিতরে আছে এমন কেউ, যে কেবল এই সব কিছুর দর্শক?


🌧️ আধ্যাত্মিক বিষাদ: ঈশ্বরের ভাষা

জীবন যখন ক্লান্তির চূড়ায় এসে দাঁড়ায়, তখনই এক নতুন প্রশ্ন উঁকি দেয়—“সবকিছু থাকার পরেও এই শূন্যতা কেন?”
এই শূন্যতা থেকেই জন্ম হয় আধ্যাত্মিক বিষাদের, যা একজন মানুষকে আস্তে আস্তে দার্শনিক করে তোলে।

ভাগবতের প্রথম স্কন্ধে, রাজা পরীক্ষিতকে দেখি—সমগ্র পৃথিবীর শাসক হয়েও তিনি সিংহাসন ছেড়ে নদীর ধারে বসে যান।
কেন?

কারণ তিনি বুঝেছিলেন,

📖 “শরীর ক্ষণস্থায়ী, রাজ্য ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আত্মা অবিনশ্বর।”
(শ্রীমদ্ভাগবত, স্কন্ধ ১)

এই উপলব্ধি আসে না ততক্ষণ, যতক্ষণ না ভিতরের বিষাদ হৃদয় ভেঙে ফেলে।


🔥 অহং ভাঙা — আত্মার উন্মোচন

আধ্যাত্মিক বিষাদ আসলে অহংকারের মৃত্যু।
এ বিষাদ এমন এক বেদনা, যা তোমার মনের তৈরি সব “আমি”কে ভেঙে দেয়—
আমি সফল, আমি ব্যর্থ, আমি ভালো, আমি দুঃখী — সব ভেঙে যায়।

তারপর কোথাও থেকে এক নতুন আমি জন্ম নিতে চায়, যে আর ব্যস্ত নয় বাহ্যিক চেহারায়, বরং তাকিয়ে থাকে ভিতরের সত্যে।

এখানেই ভাগবতের দর্শন জেগে ওঠে।

📖 যে ব্যক্তি নিজের আত্মাকে চেনে, সে কারও প্রতি রাগ পোষণ করে না, কারও জন্য ঈর্ষা অনুভব করে না।”
(ভাগবত গীতা ৫.১৮)


🌱 ভক্তির জন্ম: বিষাদ থেকে বিশ্বাসে উত্তরণ

যখন সমস্ত দম্ভ ভেঙে চুরমার হয়, তখন এক অদ্ভুত নির্ভরতা জন্ম নেয় ঈশ্বরের উপর।
এ নির্ভরতা ভয় নয়, প্রয়োজনীয়তাও নয়—
বরং একপ্রকার আত্মসমর্পণ।

ভাগবতের মধ্যে ‘ভক্তি’ অর্থ শুধু ঈশ্বরের নামে জপ নয়, বরং নিজের সমস্ত অহং, আশা, অভিমান সব দিয়ে তাঁকে বলার চেষ্টা—
“তুমি আমাকে নিয়েই নাও, আমি আর জানি না কোন পথ ঠিক।”


💫 উপসংহার: আত্মার প্রথম দেখা

এই প্রথম পর্বের মতো, আধ্যাত্মিক যাত্রার শুরুও হয় এক নিঃশব্দ প্রশ্ন থেকে—
“আমি কে?”

যতবার এই প্রশ্ন হৃদয়ে দোলা দেয়, ততবার ভাগবতের প্রতি ফিরে তাকালে দেখা যায়—
সেই প্রশ্নের উত্তর কেউ না কেউ চিরকাল খুঁজে চলেছে, কারও মুখে, কারও চোখে, কারও ভক্তিতে।

আমার ভিতরে এখন আর সেই পুরনো “আমি” নেই।
আছে এক নতুন অনুসন্ধান, এক ধ্রুব প্রশ্নের পথ ধরে হাঁটা—

📖 “যার জীবন ঈশ্বর অনুসন্ধানে ব্যয় হয়, তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পূর্ণতা লাভ করে।”
(ভাগবত পুরাণ, স্কন্ধ ১১)


Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *